সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের পোস্টার: নিজের হাতে তৈরি কাজ।

সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের পোস্টার: নিজের হাতে তৈরি কাজ। 

সত্যজিৎ রায় কেবল একজন কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ গ্রাফিক ডিজাইনার, শিল্পী ও লেখকও। তাঁর সিনেমার পোস্টার, বিজ্ঞাপন, এবং প্রাথমিক স্কেচগুলোর মধ্য দিয়ে ধরা পড়ে তাঁর অসামান্য শিল্পবোধ, সংবেদনশীলতা ও নান্দনিক মনন। নিচে আমরা সত্যজিৎ রায়ের পোস্টার ডিজাইন, প্রোমোশনাল বিজ্ঞাপন এবং চরিত্র বা দৃশ্যের স্কেচ নিয়ে একটি সামগ্রিক গল্প তুলে ধরছি।


🎨 শুরুটা: শিল্পী হিসেবে রায়

সত্যজিৎ রায়ের শৈল্পিক যাত্রার শুরু চলচ্চিত্র দিয়ে নয়, বিজ্ঞাপন সংস্থা D.J. Keymer-এ গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে। এই কাজ থেকেই তিনি টাইপোগ্রাফি, কম্পোজিশন ও চিত্রাঙ্কনে পারদর্শিতা অর্জন করেন। এই অভিজ্ঞতা পরবর্তীতে তাঁর সিনেমার পোস্টার ও স্কেচে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।


🎬 চলচ্চিত্রের পোস্টার: নিজের হাতে তৈরি দৃষ্টিনন্দন কাজ

সত্যজিৎ রায় তাঁর বেশিরভাগ সিনেমার পোস্টার নিজেই এঁকেছেন বা ডিজাইন করেছেন। এতে শুধু সিনেমার গল্প নয়, ধরা পড়ত সিনেমার মেজাজ ও অন্তর্নিহিত দর্শন।

🖼️ উল্লেখযোগ্য পোস্টার:

  1. পথের পাঁচালি (1955)

    • মূল পোস্টারটি ছিল ব্ল্যাক-অ্যান্ড-হোয়াইটে, হস্তলিখিত বাংলা অক্ষরে সিনেমার নাম।

    • তিনি ছোট্ট অপু আর দুর্গার ছবি ব্যবহার করেছিলেন, যেটা গল্পের আবেগ তুলে ধরে।

  2. চারুলতা (1964)

    • পোস্টারে ব্যবহৃত হয় একটি রোমান্টিক অথচ আবদ্ধ নারীর প্রতীকী চিত্র, একটি জানালার গরাদের আড়ালে মুখ।

  3. গুপী গাইন বাঘা বাইন (1969)

    • কার্টুন-ধর্মী স্কেচে মুখ্য চরিত্রদের রঙিনভাবে তুলে ধরা হয়েছিল। এটিতে হিউমার ও ফ্যান্টাসির ছোঁয়া ছিল।

  4. হিরক রাজার দেশে (1980)

    • পোস্টারে হিরক রাজার বিশাল মুখ, নিচে প্রজাদের সারি। একটি রাজনৈতিক ব্যঙ্গচিত্রের মতো।


✏️ স্কেচ ও চিত্রনাট্য: ভিজ্যুয়াল প্ল্যানিং

সত্যজিৎ রায় তাঁর প্রতিটি ছবির শুটিংয়ের আগে স্কেচ করতেন। এই স্কেচগুলো শুধু প্রপস বা কস্টিউমের ধারণা নয়, অনেক সময় পুরো শট কম্পোজিশনের জন্য তৈরি হতো।

উদাহরণ:

  • দেবী (1960) সিনেমায় শর্মিলা ঠাকুরের চরিত্র 'দয়া'-কে দেবীরূপে তুলে ধরতে তিনি একাধিক স্কেচ করেছিলেন, যেখানে চোখ, গহনা ও আলো-ছায়ার ব্যবহার নির্ধারণ করেছিলেন আগেভাগেই।

  • শতরঞ্জ কা খিলাড়ি (1977) সিনেমায় লখনউর নবাবদের রাজকীয় বসার ঘরের ডিটেইলস তিনি হাতে এঁকে ফেলেছিলেন, যাতে সেট ডিজাইনার বুঝে নিতে পারেন কোন আলোতে শট নেওয়া হবে।


📢 বিজ্ঞাপন ও প্রোমোশনাল মেটেরিয়াল

তাঁর চলচ্চিত্রের প্রচারণায় রায় কখনোই শুধুমাত্র বানিজ্যিক মানসিকতায় কাজ করেননি। তাঁর পোস্টার, হ্যান্ডবিল, বুকলেট বা ট্রেলারের স্ক্রিপ্টেও ছিল চিন্তাশীলতা।

  • বুকলেট বা বুকমার্ক: "অপুর সংসার" মুক্তির সময় কলকাতায় বিতরণ করা হয়েছিল একটি ছোট বুকলেট যাতে অপু ও অপুর জীবনের সংক্ষিপ্ত টাইমলাইন ছিল – যা ছিল অভিনব প্রচারণা।

  • টাইপফেস ও লেটারিং: রায় নিজে বাংলা ও ইংরেজি টাইপফেস ডিজাইন করেছিলেন (যেমন "Ray Roman", "Ray Bizarre") যা অনেক পোস্টারে ব্যবহার হয়েছিল।


🗃️ উত্তরাধিকার ও সংরক্ষণ

বর্তমানে সত্যজিৎ রায়ের স্কেচ, পোস্টার ও বিজ্ঞাপনগুলি ভারত সরকারের ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভ, সত্যজিৎ রায় আর্কাইভ (Satyajit Ray Society) এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কালচারাল মিউজিয়ামগুলোতে সংরক্ষিত আছে।

  • বই: "Satyajit Ray: A Vision of Cinema" বইতে অনেক দুর্লভ পোস্টার ও স্কেচ প্রকাশিত হয়েছে।

  • প্রদর্শনী: 2021-এ তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে দেশে-বিদেশে একাধিক প্রদর্শনী হয় তাঁর পোস্টার ও স্কেচ নিয়ে।


🎯 উপসংহার

সত্যজিৎ রায়ের পোস্টার, বিজ্ঞাপন এবং স্কেচ শুধুই সহায়ক মাধ্যম নয় – সেগুলো তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি, শৈল্পিকতা এবং দুনিয়ার প্রতি গভীর উপলব্ধির প্রকাশ। তাঁর ছবির মতোই, তাঁর পোস্টারও সময়ের সাথে সাথে কালজয়ী হয়ে উঠেছে।


Comments

Popular Posts