দেশে বিদেশে তানীম নূর এর উৎসব চলছে
'পরিবার ছাড়া দেখা নিষেধ' এমন ট্যাগলাইন দেখার পর 'উৎসব' সিনেমাটা পুরো পরিবার নিয়েই সিনেমা হলে গিয়ে দেখার ইচ্ছে ছিল। এর মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার (১৮ জুন) দুপুরে হঠাৎ-ই বড় ছেলে অনলাইনে জানতে চাইলো- সন্ধ্যার পর ফ্রি থাকবো কি না? তাহলে পরিবারের সকলে মিলে উৎসব দেখার টিকিট করবে। আমার সায় পেয়ে দশ মিনিটের মাথায় টিকিট কেটে সেটার ছবি পাঠিয়ে দিল। পরিবারের আমরা ছয় জন মিলে সীমান্ত সম্ভারে দেখলাম-উৎসব।
অকপটে স্বীকার করছি- ছবির পরিচালক তানীম নূরকে আমি চিনি না। নিকট অতীতে তার নাম শুনেছি বলেও মনে পড়ছে না। হলের লিফটে জনৈক ভদ্রলোকে জানতে চাইলেন, কোন সিনেমা দেখতে যাচ্ছি? উৎসব শুনে খুশি হলেন। বললেন-‘দারুণ ছবি। দুবার দেখেছি। আমার পরিবারের লোকজন কোথায়-জানতে চাইলেন। বললাম, ওরা আগের লিফটে উঠেছে। ভদ্রলোক খুশি মনে মাথা নাড়লেন।
উৎসব সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন জাহিদ হাসান। তার কৈশোর, তারুণ্য, যৌবন এবং প্রেম-বিয়ে-বিরহ এসব নিয়েই গল্প এগিয়ে চলে। জাহিদ হাসানকে সঙ্গ দেন- তারিক আনাম খান, চঞ্চল চৌধুরী, জয়া আহসান, অপি করিম, আফসানা মিমি, ইন্তেখাব দিনার, আজাদ আবুল কালাম পাভেল, সাদিয়া আয়মান, সুনেরাহ কামাল, সৌম্য জ্যোতি। অভিনয়ের প্রতিযোগিতায়- কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান।
সিনেমা দেখা শেষে ভাবলাম-‘উৎসব’কে কী ধাঁচের সিনেমা বলবো? কমেডি না হরর? না কি পোড় খাওয়া জীবনের নিরেট সত্যের অন্যরকম প্রকাশ? সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি।
মূল গল্প ব্রিটিশ লেখক চার্লস ডিকেন্স এর A Christmas Carol থেকে নেয়া। সেটাকে ঘঁষামাজা করে ঢাকার কোনো এক মহল্লার উপযোগী করে বানিয়েছেন- নির্মাতা তানীম নূর। এরকম সিনেমার ইতিহাস আমাদের দেশে রীতিমত বিরল। সিনেমাজুড়ে এত তারকার ছড়াছড়ির মধ্যেও প্রায় সব চরিত্রকেই মনে হয়েছে আশেপাশের মানুষ। পাশের বাড়ির, খুব চেনা।
সিনেমার চিত্রনাট্যে অসাধারন সেন্স অব হিউমার ছিল। অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তাদের বডি ল্যাংগুয়েজ এবং বেশ কিছু সংলাপ দিয়ে হলভর্তি মানুষদের হাসাতে পেরেছেন। দীর্ঘদিন পর হলে বাংলা সিনেমা দেখে দর্শক এমন প্রাণখুলে হেসেছে। না, শুধু হাসেনি। কেঁদেছেও দর্শক। উৎসব বিশাল বাজেটের সিনেমা নয়। মারামারি-রাহাজানি-নাচাগানা ছাড়াও অত্যন্ত সাদামাটা চিত্রায়ণের মাধ্যমে, গল্পের গাঁথুনিতে যে দর্শক আটকে রাখা যায়- তার উদাহরন উৎসব।
পরিচালকের পরিমিতিবোধ দেখে মুগ্ধ। ‘খাইস্টা জাহাঙ্গীর নিপাত যাক, শান্তিনীড় মুক্তি পাক’ টাইপের বিশাল ব্যানার টানানো, জাহিদ হাসানের কিপটামী, ঈদের সালামী ৪ টাকা দিয়ে তা ফেরত নেয়া, কম দামের পেস্ট ব্যবহারের স্বপক্ষে যুক্তি দেখানো-এরকম প্রতিটা দৃশ্যে মানুষ প্রাণখুলে হেসেছে। বিভিন্ন সংলাপ দশর্ককে হাসিয়েছে-একবারের জন্যও সেটাকে কিন্তু ভাঁড়ামি মনে হয়নি। এরকম কমেডি জাহিদ হাসান, জয়া আহসান, চঞ্চল চৌধুরী, অপি করিম অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে করতে পেরেছেন। সেই কমেডি করার জন্য যে মুনশিয়ানার দরকার ছিল-তার শতভাগই ছিল উল্লেখিত অভিনেতা এবং পরিচালকের।
উৎসব সিনেমার প্রাণ এর কাহিনি। জীবনের শেষদিকে এসে অতীত জীবন নিয়ে নস্টালজিয়ায় ভোগা! জীবনে ছোট ছোট জিনিস একটু অন্যভাবে করলে, অন্যভাবে ভাবলে দিনশেষে জীবনটা হয়তো অন্যরকম হতে পারতো। সিনেমা শেষে জাহিদ হাসানের জীবনের প্রাপ্তী-অপ্রাপ্তীর হাহাকার, কণ্যার সঙ্গে তার স্বল্প সময়ের মিলন দেখে; একই সঙ্গে আফসোস এবং তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে হল থেকে বেরিয়েছে দর্শক।
ছবির বেশ কিছু সংলাপ মাথায় পোকার মতো কিটকিট করছে।তারমধ্যে কয়েকটা এমন-
'ডানা থাকলেই উড়তে হয় না।'
'আমাদের লাইফটা আসলে বোরিং না, লাইফস্টাইলটা বোরিং।'
'এই শহরে সবাই একা, কিন্তু সবাই সবার সাথে।'
'আসলে জীবনটা একটা উৎসবের মতো, যেখানে সবাই আসে, কিছুক্ষণ থাকে-তারপর চলে যায়।'
‘ক্ষমা চাইবারও একটা এক্সপায়ারি ডেট থাকে, সেই ডেটও পার হয়ে গেছে।‘
বাংলা সিনেমার দর্শকদের জন্য 'উৎসব' একদম ভিন্ন মাত্রা, ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা। একটা সিনেমায় এত হিউমার-আবেগ-কষ্ট-ভালোবাসা এবং বিরহের মিশেল নিকট অতীতে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।
ছবির মূল গল্পের পটভূমি ছিল ৯০ এর দশক। ভাড়া নেয়া ভিসিআর ক্যাসেট, সাদাকালো টেলিভিশন, সিডিআই-১০০সিসি মোটর সাইকেল, ঢোলা পেন্ট, মোটা বেল্ট, এসব খুঁটিনাটির প্রতি দারুণ নজর রাখা হয়েছে। সেজন্য পুরো উৎসব টিমকে সাধুবাদ।
‘খাইস্টা জাহাঙ্গীর’ এর এলোমেলো জীবন পাল্টে দিয়েছে ঈদের দিন দেখা হওয়া তার স্ত্রীর সঙ্গ। তার কাছে পাওয়া তথ্যে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে দর্শকও জা তে পারে-তার একটি মেয়ে আছে।সেই মেয়ের সঙ্গে সামান্য সময়ের জন্য দেখা হওয়া, বাবা-মেয়ের কথপোকথন জাহিদ হাসানের জীবনাচার বদলে দেয়।
বাংলা সিনেমার সুদিন ফিরে আসুক। উৎসব'র মতো সিনেমা বেশি বেশি তৈরি হোক। মানুষ আবারও হলমুখী হয়েছে-এটি ভালো বার্তা দিচ্ছে আমাদের।
যারা দেখেননি, তারা পরিবার নিয়ে উৎসব দেখুন। ঠকবেন না, গ্যারান্টি।
বাংলা সিনেমার জয় হোক।
কলমে: মেসবাহ্ আজাদ
Comments
Post a Comment